‘এখতিয়ার’ বিতর্ক কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে ঘিরে প্রশ্ন ও জনআস্থার স্রোত

print news
img

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য ও ভূমিকা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের ‘এখতিয়ার’ বিতর্ক এখন জনপরিসরে ব্যাপক আলোচিত। গণ-অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর ভূমিকা, প্রধান উপদেষ্টার স্বীকৃতি ও দেশের জনগণের আস্থার পটভূমিতে এই বিতর্ককে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে করছেন।

৫ আগস্ট: ভরসার প্রতীক হিসেবে জেনারেল ওয়াকার
গণ-অভ্যুত্থানের পরে ৫ আগস্ট কে ভাষণ দেবেন—সে দিন দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেই ভাষণে তিনি বলেন, “আমার ওপর ভরসা রাখেন।” এই ভাষণে তাঁকে কেউ প্রশ্ন করেননি—‘আপনি কে? কেন আপনার ওপর ভরসা রাখব?’ বরং সেদিন সেনাপ্রধান হয়ে তিনি যে নৈতিক ও নেতৃত্বগুণ দেখিয়েছেন, তাতে তিনি প্রশংসিত হন সর্বস্তরে। সশস্ত্র বাহিনী নতুনভাবে আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার স্বীকৃতি
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও গণ-অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর এবং জেনারেল ওয়াকারের প্রশংসনীয় ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন। গত ৬ অক্টোবর তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।” এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণেও তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তবুও কেন এই ‘এখতিয়ার’ বিতর্ক?
এই বাস্তবতা থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টকশোসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যকে ‘এখতিয়ারবহির্ভূত’ বলে প্রচারের চেষ্টা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—কে, কেন এই বিতর্ক উসকে দিচ্ছে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাপ্রধান মনে করেন দীর্ঘ সময় ধরে বাহিনীকে মাঠে রাখলে পেশাগত দক্ষতা ও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। সেই প্রেক্ষাপটেই তিনি গত ফেব্রুয়ারিতেই বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। তখন এটি সবাই স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন যারা এই নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়, তারাই সেনাপ্রধানকে টার্গেট করছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরেও অসন্তোষ?
সরকারি একটি বৈঠকের পর ‘এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য’ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার কথা জানানো হয়েছে। একজন উপদেষ্টার বিতর্কিত বক্তব্য নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। বরং জেনারেল ওয়াকারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা বেড়েই চলেছে।

২১ মে অফিসার্স অ্যাড্রেস: সেনাপ্রধান যা বলেন
সেই দিন সেনা সদর দপ্তরে অফিসারদের উদ্দেশে বক্তব্যে জেনারেল ওয়াকার বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া উচিত। রাখাইন রাজ্যের করিডর ইস্যুতে তাঁর ও বাহিনীর অজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে—আমরা জানি না।” একইসঙ্গে সেনা কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ থাকার এবং ভবিষ্যতের নির্বাচনী দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের নির্দেশ দেন।

আইনবিদ ও বিশ্লেষকদের মতামত
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, “আইনি কাঠামোর বাইরে চলা একটি বাস্তবতায় সেনাপ্রধানের মতামতের ‘এখতিয়ার’ মাপার কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো নেই।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, “৫ আগস্টের রাতে সেনাপ্রধানের কাঁদতে কাঁদতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা শুনেছি—তিনি যদি সেদিন ছাত্র-জনতার পক্ষে না দাঁড়াতেন, তাহলে রক্তের স্রোত বইত।”

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ড. খান সুবায়েল বলেন, “ওয়াকার সাহেব চাইলে গত বছরই ক্ষমতা নিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। আজ যারা তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, সেই কঠিন পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন।”

আইএসপিআরের বক্তব্য
আইএসপিআর জানিয়েছে, অফিসার্স অ্যাড্রেস বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিয়মিত কার্যক্রম। এটি গণমাধ্যমে প্রকাশযোগ্য নয়। তবে ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান প্রকাশ্যে ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া উচিত বলেছিলেন।

অর্থনীতি, রাজনীতি ও জনগণের চাহিদা—সব একই বার্তা দিচ্ছে
বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরাও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছেন। সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনও বলেন, “নির্বাচনের তারিখ এখন দেওয়া উচিত।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *