

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার এক ব্যবসায়ী মো. সোলাইমান হোসেন সেলিম জীবিত থাকলেও তাঁকে ‘হত্যাকাণ্ডের শিকার’ হিসেবে দেখিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায়। এমন ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। মামলার বাদী কেউ নন, স্বয়ং সেলিমের বড় ভাই গোলাম মোস্তফা ওরফে মস্তু। চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, মামলার প্রধান আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। তার সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ মোট ৪১ জনের নাম মামলায় যুক্ত করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও দেড় থেকে দুই শত জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মামলায় বলা হয়, রাজধানীর কাজলা এলাকায় গত ৩ আগস্ট সেলিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অথচ তিনি তখন দিব্যি জীবিত ছিলেন এবং নিজ এলাকার ধামর বেলতলি বাজারে মুদিদোকানে ব্যবসা পরিচালনায় ব্যস্ত ছিলেন। মামলার পেছনে দীর্ঘদিনের পারিবারিক জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং এর থেকে জন্ম নেওয়া একটি ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রই মূল কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রায় দুই দশক আগে তাঁদের পিতার মৃত্যুতে জমি নিয়ে চার ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। নিঃসন্তান সেলিমের সম্পত্তি দখলের লোভেই এ ষড়যন্ত্র সাজানো হয়েছে বলে দাবি তার পরিবারের।
সেলিম জানান, “আমি এখন জীবিত থাকার প্রমাণ দিতেই বিপাকে পড়েছি। একাধিকবার থানায় গিয়ে বুঝাতে হয়েছে যে আমি মরিনি। ভাইয়েরা সম্পত্তির লোভে আগে হামলা করেছে, এবার মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।” সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন জানান, পূর্বেও ভাইয়েরা তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, এলাকাবাসীর সহায়তায় সে যাত্রায় বেঁচে যান।
এ ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। কীভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়াই একজন জীবিত মানুষকে ‘হত্যা’ দেখিয়ে মামলা নেয়া হলো, তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুকনুজ্জামান জানান, “বাদী মস্তু একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় অনুপস্থিত। ধারণা করা হচ্ছে, সম্পত্তি দখল ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই এই মিথ্যা মামলা করেছে।” যাত্রাবাড়ী থানা ও ডিবি পুলিশের তদন্ত এখনও চলমান। ডিবি ওয়ারী বিভাগের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমিনুল ইসলাম জানান, মামলার বাদী মোস্তফা পলাতক, মোবাইলও বন্ধ, অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আদালতের নির্দেশে ভাইদের ডিএনএ পরীক্ষাও করা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে মস্তুর অন্য দুই ভাই মামলার সাক্ষী হলেও তারা দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি রুহুল আমিন বলেন, “সেলিম একজন নিরীহ মানুষ। জমির লোভে তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এটা এক ধরনের ভয়ংকর সামাজিক অপরাধ।” একই মত প্রকাশ করেন ময়মনসিংহ সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ। তাঁর মতে, “এমন ঘটনায় প্রমাণ হয় পুলিশ মামলা গ্রহণে আরও দায়িত্বশীল হতে ব্যর্থ হয়েছে। যেনতেনভাবে মামলা গ্রহণের সংস্কৃতি মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।”
একটি মানুষ জীবিত থেকেও নিজেকে ‘মৃত নয়’ তা প্রমাণে হিমশিম খায়—এটি শুধুই কোনো পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়, বরং আমাদের বিচারব্যবস্থা ও তদন্ত প্রক্রিয়ার ভয়াবহ অসংগতি প্রকাশ করে দেয়।