

বাংলা রাজনীতির এক সময়ের মুখর ও দাম্ভিক নেতা ওবায়দুল কাদের জনসভায় টেনে টেনে উচ্চারণ করতেন শুদ্ধ বাংলা, যেন লোকমুখে আলোচনার জন্ম দেন: “জ্বালা, জ্বালা রে জ্বালা, অন্তর্জ্বালা” কিংবা “পালাব না। প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব।” কিন্তু সময় সবকিছুর উত্তর দেয়। আজ সেই ওবায়দুল কাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব যেখানে দেশের মাটিতে বক্তব্য রাখছেন, সেখানে কলকাতার রাস্তায় মুখ ঢেকে হাঁটছেন এই ঘড়িবিলাসী সাবেক মন্ত্রী।
২০১১ সালে সড়কমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া ও পরবর্তীতে তিনবার দলীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা ওবায়দুল কাদের দলের ও মন্ত্রণালয়ের শক্তিকে ব্যবহার করে গড়ে তোলেন দুর্নীতির এক অব্যর্থ চক্র। তার নেতৃত্বে বিআরটিএ, সড়ক ও সেতু বিভাগে লুটপাট চলে দাপটের সঙ্গে। নোয়াখালীর স্থানীয় কিছু ঘনিষ্ঠজনকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় একচ্ছত্র আধিপত্যের এক ভয়ংকর বলয়। এ চক্রে ছিলেন স্ত্রী ইসরাতুন্নেছা, ভাই কাদের মির্জা, ভাগ্নে-মেয়ের জামাই, স্থানীয় চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে যুবলীগ নেতারা পর্যন্ত।
এই চক্র নোয়াখালীতে চালায় চাঁদাবাজি, দরপত্র দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, এমনকি নির্বাচনী প্রভাবও। সড়ক-মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প ও সরকারি অফিসগুলোর নিয়ন্ত্রণ, জায়গা দখল, অবৈধ কমিশন আদায়—সবকিছুতে ছিল এই পরিবারের হাত। বসুরহাট পৌরসভার উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে কাদের মির্জা ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, মার্কেট দখল ও রীতিমতো সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত ‘হেলমেট বাহিনী’ সাংবাদিক বুরহান মুজাক্কিরকে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে।
ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইসরাতুন্নেছাও দপ্তরে দপ্তরে তদবির চালিয়ে নানা সুবিধা আদায় করতেন। উপহারের বিনিময়ে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করতেন। এমনকি অন্যান্য মন্ত্রীদের স্ত্রীদেরও তদবিরের জন্য তাঁর সহায়তা নিতে দেখা গেছে। সরকারি অফিসগুলো হয়ে উঠেছিল এই পরিবারের ‘ব্যবসা’ চালানোর ক্ষেত্র।
মির্জা কাদের, ভাইয়ের পরিচয় ও ক্ষমতার জোরে বসুরহাটে গড়ে তোলেন ভয়ঙ্কর দখল-চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক। অন্যের জমি দখল করে আওয়ামী লীগ কার্যালয় বানানো, কোটি টাকার জমি বিনা মূল্যে আত্মসাৎ করা, ঠিকাদারদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায়, এমনকি খাসজমি বিক্রিও ছিল তাদের অপকর্মের তালিকায়। ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদ ছাড়া এসব সম্ভব হতো না। তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় পুরো পরিবার হয়ে উঠেছিল দখলদার, দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতার অপব্যবহারে সিদ্ধহস্ত।
এক সময় যারা দাপটের সঙ্গে দেশ শাসন করতেন, আজ তাদের কেউ পালিয়েছে কানাডা, কেউ যুক্তরাষ্ট্রে, কেউ আবার গা ঢাকা দিয়েছে সৌদি আরবে। বসুরহাটের জনগণ প্রতিবাদ করে কাদেরের বাড়ি পর্যন্ত পুড়িয়ে দেয়। এরপর ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালায় পুরো কাদের পরিবার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঘৃণা স্পষ্ট হয়ে উঠে এই প্রতিক্রিয়ায়।
একজন সাবেক মন্ত্রী, যিনি এক সময় বলতেন “পালাব না”, তিনিই এখন আত্মগোপনে। সময়ই প্রমাণ করেছে—শক্তির দম্ভ ক্ষণিকের, মানুষের বিচার চিরন্তন।