ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর অঘোষিত যুদ্ধ: অর্থনীতি পড়েছে গভীর সংকটে

print news
img

জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত এক অঘোষিত যুদ্ধের মুখে পড়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের হয়রানি, ভয়ভীতি, মিথ্যা মামলা ও চাঁদাবাজির কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে গেছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, দুদকে তলব, শেয়ারবাজারে ব্যক্তিগত ও কোম্পানির শেয়ারের বিরুদ্ধে মামলা এবং মব হামলার মতো ঘটনাগুলো যেন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বড় শিল্পগোষ্ঠীর ওপর চাঁদাবাজির ভয়:
দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান সম্প্রতি মব হামলার মুখে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হচ্ছে, না দিলে তাদের কোম্পানি ও পরিবারকে হামলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, এই অবস্থায় বিনিয়োগের সাহস হারিয়ে ফেলছেন তারা।

শেয়ারবাজারেও ধস:
কিছু শেয়ারের ওপর মামলা এবং তদন্তের ফলে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দাম কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে বাজারে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

চলছে মিথ্যা মামলা:
বিভিন্ন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে হত্যা বা গুরুতর অপরাধের মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের অভিযোগ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না উৎপাদনমুখী খাতের উদ্যোক্তারাও।

আস্থার সঙ্কটে বিনিয়োগকারীরা:
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) এক আলোচনা সভায় উদ্যোক্তারা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে নতুন বিনিয়োগ অনুপ্রাণিত হচ্ছে না।

বেকারত্ব বাড়ছে:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে এক বছরে সোয়া তিন লাখ বেকার বেড়েছে। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার। শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিদেশি বিনিয়োগে ধস:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ কমেছে ২৬ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এফডিআই প্রবাহ ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার থেকে নেমে এসেছে ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলারে।

দেশি বিনিয়োগেও ভাটা:
আস্থার অভাবে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ গ্রহণও কমে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৮২ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৭.১৫ শতাংশ।

অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চিফ ইকনোমিস্ট এম কে মুজেরি বলেন, “বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে নেওয়ার মতো পরিবেশ নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হয়রানি, মিথ্যা মামলা, এবং ভয়ভীতি ব্যবসায়ীদের চরম সংকটে ফেলেছে। এতে অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতাও বাড়ছে।”

শিল্প উদ্যোক্তাদের আহ্বান:
দেশীয় শিল্পপতিরা বলছেন, যারা দেশে বিনিয়োগ করেছেন, কারখানা গড়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, তাদের সুরক্ষা না দিয়ে উল্টো হয়রানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে, আগের সরকারের সময় যারা ট্রেডিংয়ের নামে টাকা বিদেশে পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।


বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি দ্রুত ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি না করা হয়, তাহলে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান—সবখানেই ধস নামবে। আর তা হলে অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *