

দেশে মানব পাচার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রূপ ধারণ করেছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মানব পাচারের ৪ হাজার ৫৪৬টি মামলা হলেও সাজা হয়েছে মাত্র ১৫৭ জনের। বিপরীতে খালাস পেয়েছেন ৩ হাজার ১৪১ জন। বিচারহীনতার এ চিত্রই মানব পাচারকে বেপরোয়া করে তুলেছে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
মানব পাচারের এই চিত্র শুধু পরিসংখ্যানে নয়, বাস্তব ঘটনার মধ্যেও ভয়ংকর রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। এক ভুক্তভোগী জানান, ইতালিতে যাওয়ার আশায় জমি বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা দালালের হাতে তুলে দিলেও তাঁকে লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পরে মুক্তিপণ আদায়ের পরও তিনি লিবিয়া উপকূলরক্ষীদের হাতে আটক হয়ে কারাবন্দি হন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সহায়তায় দেশে ফিরতে পারেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে
মানব পাচারের কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বহু দেশ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। গত ১২ বছরে ওমান, বাহরাইন, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, মিসর, রোমানিয়া, ব্রুনাই ও মালদ্বীপে শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে আরব আমিরাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মিছিলের ঘটনার পর দেশটি ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এখনও পর্যন্ত সেই সমস্যা কাটেনি।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস’ রিপোর্টে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাচারের গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকেও আলোচনায় এসেছে।
দায়সারা অবস্থান প্রশাসনের
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ জানায়, এই সময়কালে ১৯ হাজার ২৮০ জনকে আসামি করা হলেও সাজা হয়েছে মাত্র ১৫৭ জনের। এর মধ্যে ২৪ জন যাবজ্জীবন, ১৩৩ জন বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, “এ বিষয়ে আমার জানা নেই। গণমাধ্যমে কথা বলার এখতিয়ার উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের রয়েছে।”
অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, “মানব পাচার প্রতিরোধে স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। শুধু দেশের আইন প্রয়োগে হবে না, আন্তর্জাতিকভাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের নামে প্রতারণার অভিযোগে বহু দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি সরাসরি মানব পাচারে জড়িত। তবে ‘বৈধ পথে যাওয়া কর্মীদের ক্ষেত্রে মানব পাচারের অভিযোগ প্রযোজ্য নয়’— এমন দাবি করেছেন বায়রার নেতা ফখরুল ইসলাম।
তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, রিক্রুটিং এজেন্সির অসাধু আচরণ, ভিসা জালিয়াতি এবং চুক্তিভঙ্গ করেও কর্মীদের বিপদে ফেলে দেওয়া— এগুলোও মানব পাচারের আওতায় পড়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারেও আশার আলো নেই
দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসন খাতে দালাল সিন্ডিকেট বন্ধের দাবি উঠলেও অন্তর্বর্তী সরকার এসে দশ মাস পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ মানব পাচার রোধে প্রশাসনের সক্রিয়তা বাড়ানো এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।