

গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। একে আরও পেশাদার, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি। স্বাধীনতার পর থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের গণমাধ্যম খাত টিকে আছে, তবে মান ও কাঠামোগত দিক থেকে এখনো উন্নত দেশের মতো হয়নি, এটাও সত্য।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছাকে সাংবাদিক সমাজ সাধুবাদ জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারে সরব হয়েছেন, যা আশাজাগানিয়া। সেই লক্ষ্যেই গঠিত হয়েছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। কিন্তু কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা উদ্বেগজনক।
কমিশনের কিছু প্রস্তাব বাস্তবসম্মত হলেও অনেক সুপারিশই বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অযৌক্তিক এবং বিপজ্জনক। এতে মিডিয়া জগতে ধস নামার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে “ওয়ান মিডিয়া, ওয়ান হাউস” ধারণা অনেককে আতঙ্কিত করেছে।
এই ধারণা অনুযায়ী, এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একাধিক গণমাধ্যম থাকলে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এটি ব্যক্তি মালিকানায় হস্তক্ষেপ এবং সংবাদমাধ্যমের বহুবচন কাঠামোকে একক চ্যানেলে সংকুচিত করার মতোই।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম উদ্যোক্তারা বহু আর্থিক ক্ষতির মুখেও প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখছেন কেবল পাঠকের আস্থা ও সাংবাদিকদের জন্য। এই মুহূর্তে তারা যদি হাল ছেড়ে দেন, তাহলে মিডিয়া জগতে ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে।
কমিশনের সুপারিশ থেকে মনে হয়, এটি তৈরি হয়েছে কোনো বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে। বিশেষ করে যিনি কমিশনের প্রধান, তিনি অতীতে একটি প্রভাবশালী মিডিয়া হাউসে কর্মরত ছিলেন—এমনকি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাটিয়েছেন জীবনের বড় সময়। এমন একজন ব্যক্তি দেশের প্রান্তিক সাংবাদিকতা বা স্থানীয় মিডিয়ার বাস্তবতা কতটা বুঝতে পেরেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সাংবাদিকতার পেশাগত কাঠামো, কর্মপরিবেশ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এসব কিছু বিবেচনায় না এনে একতরফাভাবে ‘উন্নত দেশীয়’ রূপরেখা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাস্তবে গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরার নামান্তর।
আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কমিশন সরকারি মালিকানাধীন সংবাদ সংস্থাগুলোকে একীভূত করার প্রস্তাব দিয়েছে—যারা নিজেরাই বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে আসছে এবং পাঠকনির্ভরতায় ব্যর্থ। অথচ সেখানে কোন উন্নয়ন কৌশল নেই, আছে শুধু মার্জ বা বিলুপ্তির হালকা সুপারিশ।
অন্যদিকে, পুঁজিবাজারে মিডিয়া তালিকাভুক্তির প্রস্তাবও এসেছে, যা একেবারেই অবাস্তব। দেশের পুঁজিবাজার যেখানে ধসের মুখে, সেখানে অলাভজনক সংবাদমাধ্যমকে শেয়ারবাজারে তোলা মানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করা।
আরও এক বিতর্কিত প্রস্তাব হলো, দেশের সব সাংবাদিককে সমান বেতন কাঠামোর আওতায় আনা—ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের সাংবাদিক ও প্রান্তিক উপজেলার সাংবাদিকদের এক কাঠামোয় ফেলা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
এসব হঠকারী প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার সাংবাদিক চাকরি হারাবেন। মিডিয়াগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। এমন একটি অবস্থায় সাংবাদিক সমাজে ক্ষোভ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কেউ কেউ বলছেন, এতসব অযৌক্তিক চাপ সাংবাদিকদের রাজপথে নামাতে বাধ্য করবে।
বর্তমান সরকার যদি সত্যিই গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের নির্ভরযোগ্য প্রবাহে বিশ্বাস করে, তাহলে তাকে কমিশনের সুপারিশ নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে। পেশাদার সাংবাদিক তৈরি, মিডিয়ার জন্য ভর্তুকি, বৈষম্যহীন বিজ্ঞাপন নীতিমালা—এসব বাস্তবভিত্তিক সমাধানের দিকেই মনোযোগ দেওয়া জরুরি।