

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ভয়ংকরভাবে বাড়ছে মব সন্ত্রাস। কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়াইবাড়ী গ্রামে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা, চট্টগ্রামের পটিয়ায় থানায় মব হামলা, মহাখালীতে রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক রেস্টুরেন্টে হামলা এবং লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো একের পর এক ঘটনা মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন মব সহিংসতা শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, বরং মানবাধিকারের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।
মানবাধিকার সংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে ২৫৩টি মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৩১২ জন। জুন মাসেই ৪১টি গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১০ জন এবং আহত হয়েছেন ৪৭ জন। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণ ছাড়াই চোর, ডাকাত, ধর্ষক কিংবা প্রতারক আখ্যা দিয়ে মানুষকে মারধর, হত্যা এবং সামাজিকভাবে অপদস্থ করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক নিরপরাধ মানুষও ফাঁদে পড়ে হয়েছেন নির্মম নির্যাতনের শিকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মব সন্ত্রাসের পেছনে রয়েছে বিচারহীনতা এবং আইনের শাসনের দুর্বলতা। বেশিরভাগ গণপিটুনির মামলায় অপরাধীদের শাস্তি হয় না। ফলে অপরাধী চক্র জনসাধারণের আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষ বা টার্গেটকে নির্মূল করতে মব গঠন করছে। অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরাও এসব সন্ত্রাসে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক হামলার ঘটনায় বলেন, মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই অনেক সময় হামলা চালানো হয়, যা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তিনি বলেন, আইন না মানলে, দুই পক্ষের মধ্যেই নৈতিকতার পার্থক্য থাকে না। তাই কোনো অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে নেওয়া উচিত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মব সন্ত্রাস এক ধরনের সামাজিক রোগে পরিণত হয়েছে। এটি ছোঁয়াচে হয়ে উঠছে, এবং যদি এখনই কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শুধু হুঁশিয়ারি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, দেশজুড়ে মব সন্ত্রাসের এই ধারাবাহিকতা থামানো কঠিন হবে, যা গোটা সমাজকে একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।